REPORTING FROM KARAIL: করাইল থেকে বলছি
করাইল থেকে বলছি
শরীয়তপুর থেকে ঢাকা এসেছেন কলিমা খাতুন। পদ্মার ভাঙ্গনে বসতভিটা হারিয়েছেন। সব হারিয়ে পেটের দায়ে কাজ খোঁজার আশায় ঢাকায় এসে গুলশান-বনানীর কিছু উচ্চবিত্ত পরিবারের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ নিয়েছেন। অন্যদিকে রফিক মিয়া কুড়িগ্রামে ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। ব্যবসা যার সঙ্গে ভাগাভাগি করেছিলেন, তার প্রতারণার শিকার হয়ে পথে বসতে হয়েছে। কোনো উপায়ন্তর না দেখে ঢাকা এসে চাকরি নিয়েছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তারক্ষী পদে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় এসে বেগ পেতে হয়েছে মাথা গোঁজার ঠাই জোটাতে। রঙচটা, ভাঙ্গাচোড়া সবচেয়ে কমদামি বাসার ভাড়াও দশহাজারের কমে না। শেষমেশ খুঁজে পেয়েছেন কড়াইলের ঠিকানা। অল্প ভাড়ায় পেয়েছেন থাকার জায়গা। কড়াইল বা সাততলার মত নামগুলো আমাদের কাছে পরিচিত বস্তি হিসেবে, যেখানে নিম্নআয়ের মানুষদের বাস, আর তারাই শহরের কর্মসংস্থানের বড় অংশজুড়ে অবস্থান করে। পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা শহরে বস্তিতে বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ, যা নিউজিল্যন্ডের মত একটি দেশের জনসংখ্যার সমান।
ঢাকার সবচেয়ে বড় বস্তি হলো কড়াইল বস্তি। পঞ্চাশের দশকের আগে এ এলাকার জমিগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন ছিল। আনুমানিক পঞ্চাশের দশকে স্থানীয় জমি মালিকদের কাছ থেকে এখানকার জমি টিঅ্যান্ডটির জন্য দখলে নেয়া হয়। বর্তমানে যেখানে বস্তি, সে জায়গাটি টিঅ্যান্ডটি কলোনি তৈরির জন্য নির্ধারণ করা হয়। সেসময় পতিত জমিতে টিঅ্যান্ডটির কিছু কর্মচারী লেকের পাড়ে ঘর তুলে থাকত। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নানা সমস্যার শিকার কিছু মানুষ ঢাকায় এসে এই খালি জায়গায় ছাপড়া ঘর তুলে বসবাস শুরু করে। এরশাদের আমলে তারা সাময়িক অনুমতি পায় বলে শোনা যায়। এরপর বেশকিছু লোকজন এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। পরে নব্বই সালে এরশাদ সরকার জমিটি গণপূর্ত বিভাগকে হস্তান্তর করে। পরবর্তীতে জমির মালিকানা নিয়ে একসময়কার প্রকৃত মালিক, টিঅ্যান্ডটি ও গণপূর্ত পাল্টাপাল্টি মামলা করে। বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়ার সুযোগে আগে যারা লেকের পাড়ে টঙঘর তুলে থাকত, তারাও আবার কুঁড়েঘর তৈরি করে বাস করতে শুরু করে। তাদের দেখাদেখি আরও লোক আসতে শুরু করলে বস্তি গড়ে উঠে। অনেকেই ঘর তৈরি করে ভাড়া দেয়। আগে এই এলাকার কিছু অংশ নিচু ছিল, যেখানে বর্ষাকালে পানি জমে জলবদ্ধতা হতো। বাঁশের বেড়া ও পলিথিনের ছাপড়াই ছিল বেশি। পরে বসবাসরত মানুষজন ইটের সুড়কি, বালি, মাটি ফেলে জমি উঁচু করে। এখন ইটের বিল্ডিং ও টিনের ঘর উঠেছে। কাঁচা রাস্তাঘাটগুলোতেও ইটের সলিং হয়েছে।
কড়াইলের সীমানার ভেতর অসংখ্য গল্প আছে। নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনায় পিএইচডি’র বিষয় হিসেবে কড়াইলকে বেছে নেয়ার আগে এতকিছু ভাবা হয়নি। অনেকে বস্তির গড়ে ওঠাকে দেখে বিশ্বায়নের কুফল হিসেবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নগর বা শহরের পরিকল্পনায় উচ্চবিত্ত বা ধনীদের জন্য নানান সংযোজন থাকলেও গরীব মানুষদের নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। বস্তি গড়ে ওঠার পেছনের কারণ হল, অল্পবেতনে ছোট কাজ করা যে মানুষটা শহরের চড়াদামের বাড়িভাড়া দিতে অক্ষম, সে ফাঁকা জায়গা পেলে সেখানে চারটা বাঁশ পুতে মাথা গোঁজার জায়গা বানাবে। এভাবে একটা একটা করে ঘর তৈরি হতে হতে বিশাল জায়গাজুড়ে বস্তি তৈরি হয়েছে। আর বস্তির সংজ্ঞা হিসেবে যা দাঁড়ায় তা হল, শহর বা নগরে অপরিকল্পিত ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে গড়ে ওঠা আবাসন ব্যবস্থাপনাকে বোঝানো হয়; যেখানে বসবাসের ক্ষেত্রে স্থান সংকট, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং জীবনযাপনে করুণ অবস্থা লক্ষণীয়। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, পয়োনিষ্কাশন, আবর্জনা ব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত রাস্তাঘাটসহ আরো নানা ধরনের সুবিধা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যজাতীয় মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত। মজার ব্যাপার হল, ঢাকার কড়াইল বস্তিতে সেরকম অবস্থা চোখে পড়েনি। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ সবধরনের সুযোগ-সুবিধাই আছে সেখানে।
মধ্যবিত্ত এবং তার উপরে অবস্থান করা সমাজের একটা বড় অংশ বস্তিকে সবসময় নেতিবাচকভাবে দেখে। এই অংশ মনে করে, বস্তির মানুষরা মাদকাসক্ত হয়ে থাকে, নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটায়। বস্তির বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাকে ভীনগ্রহের মানুষ হিসেবে ভাবা হয়। অথচ কড়াইলের ভেতরে গেলে দেখা যায়, সেখানকার মানুষেরা নিজেরা একজোট হয়ে মাদক বিক্রেতাদের তাড়িয়েছে। সেখানকার মেয়েরা প্রতিদিন নিরাপদে কর্মস্থলে যাচ্ছে। কারোর কোনো সমস্যা হলে অন্যরা এগিয়ে আসছে। বেশ গুছিয়ে ওঠা একটা সমাজ। ড্রেন বা সুয়ারেজ সংক্রান্ত কিছু সমস্যা আছে, তবে একটা গ্রাম বা মফস্বল শহরের মতই পরিবেশ বিরাজ করছে সেখানে। তবে সব বস্তির অবস্থা কড়াইলের মত নয়। অধিকাংশ বস্তির পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর, সেখানে মানুষ নানা রোগে ভোগে, বিভিন্ন মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয়। আবার যেহেতু বস্তির ঘরগুলো সবই একতলাবিশিষ্ট, তাই একটি বস্তি অনেকবড় জমি বা ফুটপ্রিন্ট দখল করে রাখে। এখন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আবাসন যোগাতে প্রচুর জমি প্রয়োজন হচ্ছে, নির্মাণ হচ্ছে উঁচু ভবন, তাই সরকার বা বিভিন্ন মহল প্রায়ই এসব বস্তি উচ্ছেদ করে জমি খালি করার কথা বলে। কিন্তু বস্তি উচ্ছেদ আমাদেরকে কতটা সমাধান দিতে পেরেছে?
বিবিএস-এর `বস্তিতে শুমারি ও ভাসমান লোকগণনা ২০১৪` অনুযায়ী, দেশে বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৮। এর আগে ১৯৯৭ সালের জরিপ মতে তখন বস্তির সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৯৯১। সে হিসাবে ১৭ বছরে দেশে বস্তি বেড়েছে ৩৬৬ শতাংশ। বিবিএসের মতে, সুউচ্চ দালান নির্মাণ, আধুনিকায়ন ও পরিচ্ছন্নতার জন্য দেশের বড় শহরগুলোর অনেক বস্তি উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদ হওয়া মানুষরা চারদিকে ছড়িয়ে ছোট ছোট দলে মিলিত হয়ে নতুন বস্তি গড়ে তুলেছে। ফলে দেশে বস্তির সংখ্যা আরও বেড়েছে।
আমরা যদি ঢাকার গুলশান-বনানীর দিকে তাকাই, এই এলাকায় যারা আরবান সার্ভিস দিচ্ছে, অর্থাৎ সব প্রতিষ্ঠানের নিচের দিকের কর্মী, গাড়িচালক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বাসাবাড়ির গৃহকর্মী, মিস্ত্রী –এদের প্রায় সবাই কড়াইলের বাসিন্দা। এদেরকে বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো চলতে পারবে না, অর্থাৎ তাদের অপরিহার্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই। অথচ তাদের বাসস্থানের বিষয়টি নিয়ে কেউ ভাবছে না। নিজেদের স্বার্থে আমরা বস্তির মানুষদের উপরই নির্ভর করছি, আবার তাদেরকে উচ্ছেদ করে সরিয়ে দেয়ার কথাও ভাবছি। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, একটি বস্তি কিন্তু অজস্র মানুষের সংগ্রামের গল্প।
কড়াইল বস্তি এখন যে অবস্থায় আছে, সেটাকে উন্নত শহর-নগরের প্রেক্ষাপটে অপরিকল্পিত মনে হতে পারে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে সেটি স্বপরিকল্পিত। কোনো পেশাদার স্থপতি বা পরিকল্পনাবিদ এটিকে সাজাননি তা সত্যি, কিন্তু সেখানকার মানুষরা নিজেদের প্রয়োজনেই বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে সবকিছুকে একরকম গুছিয়ে এনেছে। এই মুহূর্তে বস্তি উচ্ছেদ করা হলে কী হবে? পুনর্বাসনের জন্য কাউকে হয়তো জামালপুরের গ্রামে একটা জমি দেয়া হবে। যে লোকটা ঢাকা শহরে গ্রিল বানানোর কাজ করে রোজগার করে, সে গ্রামে গিয়ে কাজ খুঁজে না পেয়ে জমি বিক্রি করে আবার শহরে ফিরবে। অনেকে উচ্ছেদের পর পুনর্বাসন হিসেবে উঁচু ভবনে আবাসন করে দেয়াকে আপাতদৃষ্টিতে সমাধান ভাবতে পারেন, কিন্তু সেটি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবেনা। এমনকি ল্যাটিন আমেরিকাতেও এমন প্রক্রিয়া কার্যকরী হয়নি। নগরায়ণ হচ্ছে, জনসংখ্যা বাড়ছে, মানুষ শহরে আসছে বা শহর বড় হচ্ছে। বস্তি থেকে যাদেরকে উচ্ছেদ করা হবে তাদের সবাইকে নতুন ভবন তৈরি করে জায়গা দেয়া সম্ভব হবেনা। রাজশাহীর যে মানুষটার এলাকায় বৃষ্টির দিনে পানি জমে যায়, সে সেখানেই মাচা তৈরি করে থাকবে। একে খারাপভাবে দেখার সুযোগ নেই। বরং এখন মাস্টারপ্ল্যানগুলোকে নতুন করে সাজাতে হবে। ধরুন সুনামগঞ্জ শহরের মাস্টারপ্ল্যান করা হচ্ছে, সেখানে কিছু জায়গা ছেড়ে রাখা হল যেখানে আগামীতে নিম্নআয়ের মানুষরা থাকবে। আগে থেকেই কিছু স্যুয়ারেজ লাইন টেনে রাখা হল। পরে যখন মানুষ সেখানে বসতি গড়বে, তখন স্যানিটেশন নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবেনা। বর্তমান সময়ে আমরা আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য উন্নতবিশ্বের কোনো পরিকল্পনা অনুসরণ করতে পারিনা, কারণ কোনো দেশেই আমাদের মত এত ঘনবসতি নেই। বরং যেখানে দশজন মিলে ঘর করছে, আমরা তাদের এপ্রোচকে পজিটিভ্লি নিয়ে তাদের সচেতন করতে কিছু করতে পারি। সরকার তাদেরকে লিগ্যাল স্ট্যাটাস দিতে পারে। এতে ‘বস্তিবাসী’ হিসেবে তারা এখন যেভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয় সেটি হবেনা। তখন শহরে গুলশান-বনানীর মত অভিজাত এলাকার পাশাপাশি নিম্নআয়ের মানুষদের এলাকার বিষয়টিও স্বীকৃতি পেত। হয়তো সেখানে রাস্তা ছোট, সরু। তাদের তো গাড়ির প্রয়োজন নেই। গাড়িনির্ভর একটা শহরের পরিবর্তে কড়াইল ভাল মডেল হতে পারে, যেখানে হেঁটে বা রিকশায় চড়েই পুরোটা ঘুরতে হবে। সেখানে বায়ু দূষণ নেই। জলাবদ্ধতা, স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে বিশেষজ্ঞরা সেগুলোর সমাধানে কাজ করতে পারেন।
ইউএন হ্যাবিটেট বলছে, টেকসই উন্নয়নের জন্য শহরব্যাপী বস্তি উন্নয়ন করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে সকলকে মৌলিক সেবাসহ পর্যাপ্ত, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী বাড়ি দিতে বস্তি উন্নয়ন নিশ্চিত করতে। এটাকে ডেভোলাপমেন্ট না বলে ইনক্রিমেন্টাল প্রসেস বলা যেতে পারে। রাস্তাগুলো কিছুটা চওড়া করা, ড্রেন তৈরি করার ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ দিয়ে মানুষ সচেতন করতে হবে। এখন যেমন সেখানে নিজের ঘর নিজেই তৈরি করছে, তেমনটাই চলতে পারে, কারণ মাঝে মিডলম্যান হিসেবে অন্যের প্রবেশ ঘটলে সেখানে লাভক্ষতির অন্য হিসাব আসবে। সেটি তাদের জন্য সুবিধাজনক হবেনা।
আমরা পুরান ঢাকাকে উপভোগ করি। তাতীরা নিজেদের থাকার জন্য তাতীবাজার তৈরি করেছিল, শাঁখের কাজ করা লোকেরা গড়েছিল শাঁখারিবাজার। কেউ তাদেরকে নকশা করে দেয়নি। নিজেদের সুবিধামতই তারা বাসস্থান তৈরি করেছিল। সেখানেও কড়াইলের মত সরু গলি, ডানে বায়ে ঘরবাড়ি চোখে পড়ে। যে জায়গায় এমনটা হয়েছে, সেই জায়গাটিকেই আপগ্রেড করে পরিচ্ছন্নভাবে সাজিয়ে দিলে পর্যটকরা বেড়াতে যাবে। ভবনগুলোকে একটু সাজিয়ে দিয়ে স্ট্রিটট পেইন্টিংয়ের মত কাজও সেখানে করা যেতে পারে। চমৎকার উদাহরণ হল ভেনিস। সরু গলি, খুব কাছাকাছি একেকটা ভবন, কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ সেখানে বেড়াতে যায়, জায়গাটাকে উপভোগ করে। নৌকায় করে ঘুরে বেড়ায়। কড়াইলকেও তেমন উপভোগ্য করে সাজিয়ে তোলা যেতে পারে। যারা যাবেন, বাইরে গাড়ি রেখে পুরোটা হেঁটে ঘুরবেন। একে উপভোগ্য জায়গা তৈরিতে যেটুকু খরচ করতে হবে, তারচেয়ে শতগুণ খরচ হবে সব ভেঙ্গে ফেলে উঁচু দালান তৈরিতে। সেটি আদৌ কতটা ফলপ্রসু হবে, তার উদাহরণ হিসেবে ভাষানটেকের পুনর্বাসন প্রকল্পের দিকে তাকাতে পারেন। নিম্নমানের নির্মাণ কাজ হয়েছে তো বটেই, যাদের ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা ছিল তারা তা পায়নি। সিন্ডিকেট সেটিকে দখল করে নেয়ায় বরং উল্টো ভাড়া দিতে হচ্ছে। আর অনেকেই নতুন কোনো বস্তির স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে ফেরত গেছে। তাছাড়া, বস্তির মত জায়গায় সামাজিক বন্ধনের একটা বিষয় দেখা যায়। অনেকগুলো মানুষ একসঙ্গে শেয়ার করে থাকছে, অনেকে মিলে একটা বাথরুম ব্যবহার করছে। একে অন্যের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াচ্ছে। ফ্ল্যাট কালচারে সেই বিষয়টা অনুপস্থিত। বস্তিতে যেই মানুষটা নিজেই নিজের ঘরটি ইটের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি করেছে, চাল বানিয়েছে, তাকে যখন ফ্ল্যাটে পাঠানো হবে সে তখন সেই ঘরটাকে নিজের করে নিতে পারবেনা। শহরের ফ্ল্যাট কালচারে যেমন, দশতলার বাসিন্দারা নয়তলার বাসিন্দাদের চেনে না, তেমনটা তাদের ক্ষেত্রে হলে তারা মানিয়ে নিতে পারবেনা। একটা মহল্লার কথাই ধরা যাক, সেখানে বিকেলে ছেলেরা হইহুল্লড় করছে, লোকজন চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। এদের যদি বহুতল ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে সেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বাঁধা পরবে।
আগামীর জন্য আমাদের প্রয়োজন টেকসই উন্নয়ন বা সাসটেইনেবল ডেভোলাপমেন্ট। দুইভাবে আগানো যেতে পারে, হয় বস্তির লোকদের শোষক হিসেবে, অথবা তাদের সঙ্গেই সহাবস্থান করে। আমরা যদি রোহিঙ্গাদেরকে দেশের ভেতর জমি দিতে পারি, তবে নিজেদের এই মানুষগুলোকে কেন উচ্ছেদ করব? কড়াইলের বস্তিকে সরিয়ে সেখানে হাইটেক পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সেই পরিকল্পনায় আবাসন থাকবে ৬ হাজার পরিবারের, যেখানে বর্তমানে কড়াইলে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৫৫ হাজারের বেশি। সেই ৬ হাজার পরিবারের প্রতিটিও পাবে মাত্র ১৫ ফুট বাই ১৫ ফুট জায়গা। আমরা কি আবার একটি ভাসানটেক প্রকল্প চাই? যেখানে বারংবার দেখা গেছে যে এভাবে বস্তির সমস্যা সমাধান হয়না? বিষয়টিকে অন্যভাবে ভাবতে হবে। সবধরনের বিষয় ও তথ্যউপাত্ত মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে করে নতুন কোন সংকট তৈরি না হয়। কড়াইলের মানুষদের একতলা ঘরগুলো না ভেঙ্গে কিছু বহুতল ভবন হতেই পারে, যেখানে অফিস হবে, আইটি ফার্ম হবে। এমন হতে পারে, দিনে কড়াইলে যে লোকগুলো বাইরে রিকশা চালায় বা অন্য কাজ করে, তাদেরকে রাতে কোনো একটা বিষয়ে ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করা। পরিকল্পিত ও সূদুরপ্রসারী উন্নয়নের মাধ্যমে কড়াইলকে স্বতন্ত্র জায়গায় রূপ দেয়া সম্ভব। আমরা যদি ভাবনাটা একটু বদলাই, তবেই সম্ভব সেই সুষম উন্নয়ন। শহর সবার, দেশ সবার, যেই উন্নয়নে সেই সবাই অন্তর্ভুক্ত থাকে, সেটাই সুষম উন্নয়ন। বস্তি একটি বিশ্বব্যপি সমস্যা যা পশ্চিমা নগরায়নের ধ্যানধারণা দিয়ে ঠিক করা সম্ভব নয়। করাইলকে আপগ্রেড করে হাই-টেক পার্কের সাথে সমন্বিত চিন্তা করাটা সারা বিশ্বে সুষম উন্নয়নের একটি রোল মডেল হতে পারে এবং বাংলাদেশ সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে পারে কিভাবে বস্তি থেকে বসতি শহরের অংশ হিসাবে গড়ে উঠতে পারে। করাইল একটি সমস্যা নয়, বরং, একটি সুবর্ণ সুযোগ।